Saturday, May 4, 2024

বিশ শতকের সৌভাগ্যবান লাজার সিলবারিস

 


কোনটা যে সৌভাগ্য আর কোনটা দুর্ভাগ্য সেটা মাঝে মাঝে গোলমাল পাকিয়ে যায়। আজকে যে লোকটা ভাবছে সে পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্ভাগা, আগামীকাল হয়তো সেই লোকটাই নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে ভাগ্যবান হিসেবে দেখতে পারে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মার্তিনিক দ্বীপের বাসিন্দা লাজার সিলবারিস ছিল সেরকম বিরল ভাগ্যবান এক মানুষ। বিশ শতকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান লোক বলা হয় তাকে।
১৯০২ সালের ৭ মে তারিখেও ওই দ্বীপের সবচেয়ে ঘৃণিত মানুষ ছিল ২৬ বছর বয়সের সিলবারিস। ভয়ংকর সব অপরাধের কারণে তাকে নিক্ষেপ করা হয়েছিল দ্বীপের সবচেয়ে দুর্ভেদ্য কারাগারের নির্জন এক গুহায়। পাহাড়ের গায়ে পাথরে নির্মিত ওই কারাগারে নিঃশ্বাস নেবার জন্য শুধু সামনের অংশে ছোট্ট ফোকর বাদে আর কোন দরোজা জানালা ছিল না। ওই কারাগার থেকে জীবনেও পালানো সম্ভব নয়।
কিন্তু তার ভাগ্যে লেখা ছিল অন্য কিছু। ১৯০২ সালের ৮ মে তারিখ সকালে ভয়ানক এক অগ্ন্যুৎপাতে মাত্র এক মিনিটের মধ্যে ওই দ্বীপের ৩০ হাজার বাসিন্দার সমাধি হয়েছিল উত্তপ্ত লাভার নীচে। চারদিন পর ধ্বংসস্তুপ থেকে আধপোড়া অবস্থায় শুধু একজনকে জীবিত উদ্ধার করা গিয়েছিল। তার নাম লাজার সিলবারিস। দুর্ভেদ্য পাথরের কারাগারই তাঁকে রক্ষা করেছিল।
লাজার সিলবারিস পরবর্তী জীবনে আমেরিকার বিখ্যাত সার্কাস দল বার্নাম এণ্ড বেইলির সাথে যুক্ত হয়ে ছোটখাট সেলেব্রিটি হিসেবে জীবন পার করেছে। তার বিজ্ঞাপনে লেখা থাকতো the man who lived through doomsday.

বাঁশ থেকে চাল

 




দিনাজপুরের সাঞ্জু রায় বাঁশ থেকে চাল সংগ্রহ করে বিস্ময় সৃষ্টি করেছেন। তাঁর দেখাদেখি গ্রামের আরো অনেকে বাঁশঝাড় থেকে ধান সংগ্রহ করে ভাত রান্না করে খাচ্ছেন। পরিবেশবিদরা আশঙ্কা করছেন ধান বাছতে বাঁশ উজাড় হতে পারে।
খবরটা পত্রিকার পাতায় দেখে ঘরের বোটানিস্টের কাছ থেকে মতামত চাইলাম। তিনি ছোটখাট একটা লেকচার দিয়ে বললেন:
"আসলে ভয়ের কিছু নেই। বাঁশের বংশের যখন আয়ু ফুরিয়ে যায় সে ফুলের মধ্যে ধানের জন্ম দিয়ে মৃত্যুবরণ করে।
ধান আর বাঁশ দুজনই একই বংশের ঘাস। মানে দুজনই ঘাস বংশের সন্তান। সেই বংশের নাম পোয়াসি। পোয়াসি বংশের দুই সন্তানের একজন বাম্বুসোইডি(বাঁশ) আরেকজন ওরাইজোইডি(ধান) পরিবারের সন্তান। অর্থাৎ ধান হলো ছোট বাঁশ, বাঁশ হলো বড় ঘাস। ধান-বাঁশ-ঘাসের মধ্যেকার এই সম্পর্ক লক্ষ কোটি বছর পুরোনো।
বাঁশ গাছে ধান পাওয়ার ঘটনা ৬০ থেকে ১২০ বছরের মধ্যে একবার হতে পারে। শতবর্ষে একবারই ফুল ফোটে বাঁশ গাছে। সে কারণে মানুষের চোখে এই ঘটনা খুব কম পড়ে। এতদিন ধরে একটা বাঁশঝাড় টিকিয়ে রাখা তো সভ্য মানুষের কাজ নয়। তবে ঘটনাটা সব বাঁশের ক্ষেত্রে ঘটে কিনা নিশ্চিত নই। দিনাজপুরে ঘটেছে বেরুয়া নামের এক জাতের বাঁশে। যাতে মনে হচ্ছে বিশেষ কোন কারণে বিশেষ কোন প্রজাতির ক্ষেত্রে ঘটনাটি ঘটে।"

অনেক গ্রামে কুসংস্কার আছে বাঁশ গাছে ফুল ফুটলে অমঙ্গল হয়। দুর্যোগ নেমে আসে। দিনাজপুরের মানুষ অবশ্য এটাকে দুর্যোগ হিসেবে দেখেনি। তারা মনের সুখে বাঁশ থেকে চাল সংগ্রহ করে ভাতের পাশাপাশি পিঠা-পুলি খেয়ে যাচ্ছে। শুধু সাঞ্জু রায়ই কয়েক মন ধান বিক্রি করেছেন ৪০ টাকা কেজি দরে। এটা জেনে ভালো লেগেছে।
বাঙালিদের কাছে এটা নতুন মনে হলেও উত্তরবঙ্গের কোন কোন আদিবাসী গোষ্ঠির কাছে এই বিষয়টা অনেক আগ থেকেই জানা। তারা বহুবছর ধরে বাঁশফুল থেকে ধান সংগ্রহ করার রীতির সাথে পরিচিত।
মানুষ গবাদি পশুর চেয়ে উন্নত জাতি হলেও সারা দুনিয়ার মানবজাতি আসলে ঘাস খেয়েই বেঁচে আছে। ধান, গম, যব, ভুট্টাসহ যত ধরণের শস্যদানা আছে সবই কোন না কোন জাতের ঘাস। সবগুলোই পোয়াসি গোত্রের সন্তান। ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপে একজন ভাতের দেবী আছেন। তাঁর নাম শ্রীদেবী। ভালো ফসলের জন্য তাঁর পুজা করা হয়। সেই দেবির আদি নামও পোহাসি।
দেখা যাচ্ছে পুরো মানবসভ্যতাই ঘাস খেয়ে টিকে আছে।

রাজু ও মীনার গল্প বনাম বাংলাদেশের আইসিটি শিক্ষার ভুল প্রয়োগ


এটা একটা বাচ্চা ছেলের কাজ। ইন্টারনেট স্পীড চেক করার একটা টুল। বানিয়েছে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অষ্টম শ্রেণী পড়ুয়া এক কিশোর। ধরা যাক ছেলেটার নাম রাজু। একটা অ্যামেচার প্রোগ্রামার সাইটে টপ-১০ হতে পেরেছে বলে খুশি হয়ে আমাকে জানিয়েছে। কিন্তু বাইরের কাউকে জানানো বারণ। আমি তবু ওকে আড়াল করে পোস্ট করছি। কারণটা পরের অংশে আসবে। আমি জানি এগুলো তার স্কুলের পড়াশোনার অংশ নয়। শখের কাজ। নিজের আনন্দের জন্য করা। কিন্তু বড় হয়ে ওসব নিয়ে পড়াশোনার ইচ্ছে।
রাজুর এসবে খুব আগ্রহ থাকলেও তার বোন মীনা একদম বিপরীত। সে এসব কাজে মোটেও আগ্রহী না। মীনা পড়ে একাদশ শ্রেণীতে। বাণিজ্য বিভাগে। তার আগ্রহ শিল্প সংস্কৃতি। সে ছবি আঁকে, গান গায়। তবে মুশকিল হলো অন্যান্য বিষয়ের সাথে তাকে আইসিটি নামক একটা বিষয় পড়তে হয়। তার শিক্ষা কিংবা ভবিষ্যত ক্যারিয়ার কোনটার সাথে এই বিষয়ের সম্পর্ক নেই। তবু তাকে ওই ঢেকি গিলতে হচ্ছে দিনের পর দিন। কারণ সবার জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে বিষয়টি। ওটার জন্য কোচিং লাগে, টিচার লাগে, অনেক সময়ও লাগে। ছোটাছুটি করে সে মোটামুটি গলদঘর্ম। কিন্তু উপায় নেই। নইলে নইলে পরীক্ষা খারাপ হবে। জিপিএ ফাইভের যুগ এটা।
আমি আইসিটির লোক না হলেও একজন প্রযুক্তিবান্ধব মানুষ। পেশাগত কারণে গত পঁচিশ বছর ধরে আইসিটি সেক্টরের সাথে নানাভাবে কাজ করছি। ফলে আমি মীনাদের আইসিটি সিলেবাসটা দেখে খুব অবাক হয়েছি। আমি ভাল করে জানি এই বিষয়টা সাধারণ ক্যারিয়ারের ছাত্রছাত্রীদের কোন কাজে আসবে না। যারা কম্পিউটার বিজ্ঞান কিংবা ওই সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করবে তাদের জন্যই দরকার।
তবু বাংলাদেশে আইসিটি বিষয়ে এমন সব অধ্যায় যুক্ত করা হয়েছে যেগুলো কেবলমাত্র কম্পিউটার বিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত। এই বিষয়টা এত কড়াকড়িভাবে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে কেন? এদেশের প্রতিটি ছাত্রছাত্রীকে আইসিটিতে বিশেষজ্ঞ হতে হবে? প্রোগ্রামিং জানতে হবে?
একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে শতাধিক বিষয় থাকে পড়ার। একটা দেশে হাজারো পেশার মানুষ থাকে। এত পেশার মধ্যে কয়টা পেশায় ওই বিদ্যা কাজে লাগবে? কম্পিউটার সায়েন্স বাদে আর কোন বিষয়ের ছাত্রছাত্রীর কী এই বিদ্যা কাজে লাগবে?
তবু কেন দেশের কোটি কোটি ছাত্রছাত্রীর অনিচ্ছুক মাথার ভেতরে জোর করে আইসিটির নামে অপ্রয়োজনীয় কিছু সিলেবাস গিলিয়ে দেবার চেষ্টা করা হচ্ছে? সাধারণ কম্পিউটার চালানোর জন্য বেসিক কিছু প্রোগ্রাম বাদে আর কিছুই দরকার নেই। যারা কম্পিউটার নিয়ে বিশেষ কিছু শিখতে চায় তারা নিজের আগ্রহে শিখবে। যেমন রাজু শিখেছে, আরো হাজার হাজার রাজু আছে বাংলাদেশে। কেউ প্রোগ্রামিং, কেউ গ্রাফিক্সে, কেউ ডেটাবেস, কেউ নেটওয়ার্কিং, যার যেটা পছন্দ সেটা বেছে নিবে। এ জন্য বিজ্ঞানের ছাত্র ছাড়াও বাণিজ্য, মানবিক সব বিভাগের ছাত্রছাত্রীকে এক যোগে জাভা, এইচটিএমল,সিএসএস, সি প্লাস প্লাস, এলগরিদম, নেটওয়ার্কিং শিখতে হবে? সবগুলার কাজ কী একই? অদ্ভুত এই নীতি। যারা শিক্ষানীতি তৈরি করেন, তাদের মাথায় কী এসব জিনিস আসে না?
আমি গত বছর নতুন কারিকুলাম নিয়ে অনেক সমালোচনা দেখেছি। স্কুলের ক্লাসে ডিমভাজি আর আলুভর্তা শিক্ষা নিয়ে প্রচুর হাসাহাসি হয়েছে। আমার মনে হয় সব মানুষের জীবনে কোন না কোন সময়ে ডিমভাজির শিক্ষাটা কাজে লাগবে। কিন্তু ৯৯% মানুষের জীবনে একবারও এসব প্রোগ্রামিং শিক্ষা কোন কাজে আসবে না। অথচ ডিমভাজি নিয়ে অভিভাবকদের যেরকম সরব হতে দেখেছি আইসিটি নিয়ে কোন কথা বলতে শুনি না। আমার মতে আইসিটি ডিমভাজির চেয়েও অপ্রয়োজনীয় একটা বিষয়।
আইসিটির মতো বিষয় থাকবে ঐচ্ছিক। ওটা এক্সট্রা কারিকুলামের অংশ। যার ভালো লাগবে সে শিখবে, পড়বে, ক্যারিয়ার গড়বে। কিন্তু আপনারা সারা দেশের সব মানুষকে রাজু বানিয়ে ফেলতে চাইছেন জোর করে। অথচ দেশে রাজু বানাবার মতো কয়টা বিশ্ববিদ্যালয় আছে সেটা ভেবেছেন? তাছাড়া দেশে কী শুধু রাজু তৈরি হবে? মীনাদের কোন দরকার নেই? যে ছাত্র/ছাত্রী ওই বিষয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নয়, তাকে কেন অপ্রয়োজনীয় একটা শিক্ষা জোর করে গিলিয়ে খাওয়াতে হবে?


 

Monday, April 22, 2024

সেন্ট মার্টিন দ্বীপের বিচিত্র আলোকমালা: বায়োলুমিনিসেন্স




আমি জানি না সেন্টমার্টিন দ্বীপে রাতের বেলা এই দৃশ্য দেখার অভিজ্ঞতা আর কারো হয়েছে কিনা। সেটা জানার জন্য ত্রিশ বছর আগের একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি।

১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহের ঘটনা। চট্টগ্রাম থেকে বেড়াতে আসা ছয় তরুণের একটা দল গল্প করতে করতে সেন্টমার্টিন দ্বীপের পূর্ব দিকের সৈকত ধরে হাঁটছিল। এডভেঞ্চারপ্রিয় দলটা সেদিন দুপুরে এসেছে একটা জেলে নৌকায় চড়ে। উত্তাল সমুদ্র পেরিয়ে নৌকাটা যখন খাবি খেতে খেতে সৈকতে এসে পৌঁছালো তখন চরের মধ্যে ঘুরতে থাকা দু চারজন বাদে আর কেউ ছিল না। ওই দ্বীপে তখন কোন ঘাট ছিল না। নৌকা সরাসরি এসে সৈকতে লাগতো। সৈকতে সারি সারি জেলে নৌকা বাদে আর কিছু নেই। ধূ ধূ বালিয়াড়ি, নারিকেল গাছ আর কেয়া ঝাড় শুধু। সাগর গরম থাকায় সেদিন সেন্টমার্টিনের কোন জেলে নৌকা সমুদ্রে নামেনি। টেকনাফ থেকেও এই একটি নৌকা বাদে কোনও নৌকা আসেনি। সেন্টমার্টনে তখনো পর্যটন ব্যাপারটা চালু হয়নি। মাঝে মাঝে দলছুট দুয়েকজন বাদে সেই দ্বীপে কেউ যেতো না। হুমায়ূন আহমদের সমুদ্র বিলাস তখনো তৈরি হয়নি।
ছয়জনের দলটি যখন আগের রাতে টেকনাফে ঘুরে ঘুরে সেন্টমার্টিনে যাবার উপায় খুঁজছিল তখন বাজারের লোকজন তাদের নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করছিল। দুয়েকজন তো এমন ভয় দেখালো ওই দ্বীপে গেলে জলদস্যুদের হাতে সর্বস্ব হারিয়ে ফিরে আসতে হবে। কিন্তু সেসব ভয়কে জয় করে দলটা যে কোন উপায়ে যেতে মরিয়া ছিল। তাদের কারো বাসায় জানে না এই অভিযানের কথা। সবাই বলে এসেছে কক্সবাজার বেড়াতে যাচ্ছি চারদিনের জন্য।
দিকনির্দেশনাহীন সেই ভ্রমণে অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেগুলো অন্য সময়ে বলা যাবে। আপাতত সেই রাতের ঘটনাটা বলা যাক।
একটা ঝুপড়ি দোকানে রাতের খাওয়া শেষ করে ঘুটঘুটে অন্ধকার দ্বীপে গ্রাম্য পথ ধরে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে রাত দশটার পর ঘুমানোর জন্য নির্ধারিত আস্তানায় রওনা হলো দলটা। আস্তানাটা হলো পূর্বদিকের সৈকতের ওপর দাঁড়ানো গণস্বাস্থ্যের রেস্টহাউস। ভাগ্যক্রমে নৌকায় আসার পথে ওই রেস্টহাউসের কেয়ারটেকারের সাথে পরিচয় হয়েছিল দলের একজনের সাথে। তাঁর সাথে রফা করে ১০০ টাকার বিনিময়ে একটা রুমে ছজনের থাকার বন্দোবস্ত। সৈকতের বালিতে ঘুমানোর জন্য প্রস্তুতি নিয়ে যাওয়া দলটার জন্য একটা ডাবল খাট সমৃদ্ধ এক রুমের এই আস্তানা পাঁচ তারকা হোটেলের চেয়ে বেশি ছিল।
নিঝুম সৈকতে বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ করে থমকে দাঁড়ালো দলটা। বাম দিকে তাকিয়ে দেখলো সমুদ্র থেকে নীল রঙের ঢেউ এসে লুটিয়ে পড়ছে দূরের সৈকতে। প্রথম দেখায় সবাই ভাবলো কোথাও থেকে আলো এসে পড়েছে বলে ঢেউয়ের নীলাভ ফেনা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বিদ্যুতবিহীন দ্বীপে আলো আসবে কোথা থেকে? হারিকেন আর কুপিবাতি ছাড়া ওই গ্রামে আর কোন আলোর উৎস নেই।
দলের মধ্যে সেন্টমার্টিন নিয়ে খানিক পড়াশোনা করা একমাত্র সদস্য আমি। তাই সবাই আমার দিকে তাকালো কোন উত্তর আছে কিনা। কিন্তু আমার পড়াশোনা সেন্টমার্টিনের সমুদ্রের তলদেশে প্রবালের রঙিন বাগান পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। সেটাও পশ্চিম সৈকতে। পূর্বদিকে এই ঘটনা ভারী অদ্ভুত।
রহস্যময় আলোর ছটা দেখে কৌতূহলী হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম যেখানে ঢেউগুলো সৈকতে আছড়ে পড়ছে সেই জায়গাতে। কাছে যাবার পর আমাদের মাথা ঘুরে যাবার দশা। ঢেউগুলো যখন সৈকতে ভেঙ্গে পড়ছে তখন লক্ষ কোটি তারকা যেন ছড়িয়ে পড়ছে বালির ওপর। দূর থেকে ঢেউটা দেখতে নীল মনে হচ্ছিল। কিন্তু ঢেউ ভেঙ্গে পড়ার পর দেখলাম লাল নীল সবুজ হলুদ কমলা নানান রঙের তারকা সৈকতে ছড়ানো। আকাশে তাকিয়ে যত তারা দেখছি নীচের সৈকতেও তার চেয়ে কম নয়। ভয় আর আনন্দের যুগপৎ শিহরণে আমরা নেচে উঠলাম সবাই।
কাছে গিয়ে ভেজা বালিতে হাত দিয়ে জিনিসটা তুলে নিলাম। হাতে নেবার পর হাতও নীলাভ রঙে আলোকিত হয়ে গেছে। ওই আলোতে ঘড়ির সময় দেখেছিলাম মনে আছে। কিন্তু জিনিসটা কী বুঝতে পারছিলাম না। টর্চ জ্বালিয়ে দেখলাম স্বচ্ছ দানাদার কোন পদার্থ মনে হলো। চিনির দানা যতটুকু, ততটুকু আকার। হাতে নিলে একটু উষ্ণবোধ হয়। আমাদের জীবনে দেখা সবচেয়ে আশ্চর্য একটা দৃশ্য।
তখন ভেবেছিলাম এই দৃশ্য সেন্টমার্টিনে সবসময় দেখা যায়। কিন্তু পরবর্তী ত্রিশ বছরে আরো কয়েকবার সেন্টমার্টিন গেছি, ওই দৃশ্যের দেখা আর কখনো পাইনি। সেই অপরূপ দৃশ্যের ছবি তোলার সুযোগ হয়নি। আমাদের কাছে যে সাধারণ ক্যামেরা ছিল তাতে ওই দৃশ্য ধারণ করা সম্ভব ছিল না। এতদিন পর মনে হচ্ছে সেই দৃশ্যের উৎস ছিল ‘বায়োলুমিনিসেন্স’ জাতীয় কিছু। যেটা প্লাঙ্কটন বা কোন ধরণের সামুদ্রিক অনুজীব থেকে ছড়ায়। বিশেষ কোন দিনে কিংবা বিশেষ কোন পরিবেশ পরিস্থিতিতে সেগুলো আবির্ভূত হয়।
এখন কত হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন সেন্টমার্টিন যায়। কিন্তু কারো কাছ থেকে ওরকম অপরূপ দৃশ্যের কোন অভিজ্ঞতার সন্ধান পাইনি। কয়েকদিন আগে সেন্টমার্টিনের এক বাসিন্দা ওই দৃশ্যের একটা ছবি পোস্ট করলেন ফেসবুকে। ছবিটা দেখে আমি চমকে গেলাম। এই তো সেই ঢেউ ৩০ বছর আগে যেটা আমরা দেখেছিলাম সৈকতে দাঁড়িয়ে। তাঁর কাছ থেকে ছবিটা ধার নিলাম এই লেখার জন্য। কিন্তু সৈকতে ঢেউ ভেঙ্গে পড়ার পর যে লক্ষ কোটি তারার মেলা বসে সে দৃশ্যের ছবি নেই।
আমি জানি না আমার বন্ধু তালিকায় সেই দৃশ্য দেখার অভিজ্ঞতা আছে তেমন কেউ আছে কিনা। যদি কেউ থাকেন, তাহলে আপনার অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন। সম্ভব হলে ছবিও।
পৃথিবীর খুব বেশি জায়গায় এরকম দৃশ্য নেই। গুগল করে অল্প যে কয়টি ছবি দেখলাম সবগুলোতেই নীল রঙ। ৩০ বছর আগে আমরা যে বহু রঙের তারার মেলা দেখেছিলাম কোথাও সেই দৃশ্য নেই। কেন নেই? তার মানে যে জীবগুলো ওই রঙের সৃষ্টি করতো সেগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে পরিবেশ দুষণের কারণে? আমি জানি না।
আজ নাকি Earth Day, এই দিবসটা পৃথিবীর জন্য মন খারাপ করে দেয়। আমরা প্রায় ৮০০ কোটি মানুষ প্রতিদিন এই গ্রহটাকে একটু একটু করে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছি।
......................................................
[** পোস্টে ব্যবহৃত তিনটি ছবির দুটি নিয়েছি সেন্টমার্টিনের বাসিন্দা তৈয়ব উল্লাহ ভাইয়ের কাছ থেকে। আরেকটি ছবি নেয়া হয়েছে ক্যারিবিয়ান দ্বীপের একটা সাইট থেকে ]

Friday, April 19, 2024

চোখের আলোয় দেখেছিলাম

লেখালেখির কাজে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে চোখ। দিনের অর্ধেকের বেশি সময় স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে কাজ করতে হয়। চশমার পাওয়ার বাড়তে বাড়তে আকাশচুম্বী। কিছুদিন পর স্বাভাবিক দৃষ্টিতে কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে। এত কিছু পড়তে হয়, সবকিছুতে চোখের ব্যবহার। মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। অথচ রাতের বেলা দুই চোখে ঘুম থাকে না। দিনের অভ্যেসে জেগে থাকে কোন কাজ না থাকলেও। মাথার ওপর ছাদ না থাকলে আকাশের তারা গুনতাম। আমি যে বাসায় থাকি তার ওপরে আরো পাঁচটা বাসা আছে। তার ওপর ছাদ। সেই ছাদে কখনো শোবার সুযোগ পাইনি। ছাদে শুয়ে ঘুমোতে কেমন লাগে একবার দেখতে হবে। বারো তলার ছাদের ওপর মাদুর পেতে বালিশ নিয়ে শুয়ে থাকতে হবে। নক্ষত্রের কাছ থেকে আলো ধার নিয়ে আরো কিছুদিন পৃথিবীর রূপরস উপভোগ করতে চাই। জ্ঞানচর্চার জন্য দৃষ্টি শক্তিকে বিসর্জন দেয়ার উপযোগিতা কতখানি? এভাবে কখনো ভেবে দেখিনি। মাঝে মাঝে ভাবা উচিত।

বাবার নোটবুক ১৯৫৫

 






হঠাৎ করে আমার বাবার পুরোনো একটা পকেট ডায়েরি আবিষ্কার করলো আমার পুত্র। যে জিনিস আমি নিজেও কোনদিন দেখার সুযোগ পাইনি। দাদীর সাথে খাতির করে তাঁর পুরোনো রত্নভাণ্ডার থেকে এটা উদ্ধার করেছে সে। ব্যক্তিগত জিনিস হলেও শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারলাম না কারণ সেখানে বাবার তারুণ্যের দুটো কাব্য প্রতিভার নিদর্শন রয়েছে। যার একটা বাংলা আরেকটা ইংরেজি। যদিও নিশ্চিত নই এগুলো মৌলিক কবিতা নাকি অন্য কারো বই থেকে টুকে নেয়া। কিন্তু বিষয়টা চমকপ্রদ এবং ১৯৫৫ সালের এত চমৎকার একটা ডায়েরি খুঁজে পাওয়াটাই আমার জন্য দারুণ ব্যাপার। ২৭ বছর আগে প্রয়াত বাবার এই স্মৃতিটা এখন আমার কাছে অমূল্য সম্পদ।

লেখালেখির বয়স

শেখার কোনও বয়স নেই, শেখার কোনও শেষ নেই, শিখতে কোনও লজ্জা নেই। আমি সব জেনে বসে আছি এই ধারণা যার ভেতরে ঢুকবে তার শেখার সম্ভাবনা শেষ। আমার প্রতিদিনই নতুন কিছু শেখার আগ্রহ জাগে। অনেক ক্ষেত্রে আমি শেখার সূত্র পাই তরুণদের কাছ থেকে। আমার বন্ধুতালিকায় যত পড়ুয়া আছে, তাদের অধিকাংশই আমার চেয়ে বয়সে কনিষ্ঠ, কিন্তু জ্ঞানে আমার চেয়ে অনেক ভারী। আমি প্রতিনিয়ত তাদের কাছ থেকে কিছু না কিছু শেখার সুযোগ পাই। নাম বলছি না, কিন্তু এখানে এমন কয়েকজন আছে তারা জীবনে যত বই পড়েছে, আমি তত বই চোখেও দেখিনি।
 
মাঝে মাঝে দেখি প্রবীন লেখকদের কেউ কেউ বলেন আজকালকার তরুণরা যা লিখছে তা কিছুই হচ্ছে না,তাদের দেবার কিছুই নেই। দুর্ভাগ্য তাঁদের তাঁরা নিশ্চয়ই শুধু খারাপ লেখকদেরই দেখেছেন। আমার সৌভাগ্য আমার চোখে পড়া অধিকাংশ তরুণ দারুণ প্রতিভাবান। আমার বন্ধু তালিকায়ও এমন কয়েকজন আছেন তারা দেশের যে কোন প্রতিষ্ঠিত লেখকের চেয়ে অনেক ভালো লেখে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে অধিকাংশই প্রচারের আলোয় থাকে না। অন্তত মূলধারার সাহিত্য বলে যেটা আছে সেখানে তাদের লেখাপত্রের প্রচার দেখি না।

এটা গেল সাহিত্যের কথা। এবার ইতিহাসের কথা বলি। যেহেতু ইতিহাস নিয়ে একটু পড়াশোনা করি, আমার ধারণা ছিল আমি পৃথিবীর ইতিহাস সম্পর্কে মোটামুটি অনেকদূর জেনে গেছি। সেদিন এক কিশোরকে দেখে আমার সেই ধারণা বড় ধরণের ধাক্কা খেলো। মাত্র আধঘন্টার আলাপে সে আমাকে পৃথিবীর ইতিহাসের এমন গুরুতর কিছু তথ্য শেখালো, যেগুলো আমার জানা ছিল না। যেটা শিখতে গেলে আমার দশটা ভলিউম উল্টাতে হতো। যে যুগে তরুণরা বই পড়ে না বলে দুর্নাম আছে সে যুগে এই তরুণেরা আমাদের জন্য আলোকবর্তিকা হতে পারে।
 
অতএব, এই আকালের দিনে বাংলা সাহিত্যে যেসব তরুণ ভালো কাজ করছে তাদের উৎসাহ দেয়া উচিত। যেসব প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক এখন আর ভালো লিখছেন না, শুধু নাম হয়েছে বলে মূলধারার সাহিত্যের আসরগুলো দখল করে আছেন, তাদের উচিত অবসরে যাওয়া। তাঁদের কারণে অনেক প্রতিভাবান তরুণ পত্রিকার পাতায় জায়গা পাচ্ছে না। এই প্রসঙ্গে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় চমৎকার একটা সরস লেখা লিখেছিলেন। লেখাটি আমার বিশেষ প্রিয় এবং প্রাসঙ্গিক বলে এখানে যুক্ত করলাম। শ্যামল যদিও পশ্চিমবঙ্গের বাস্তবতায় লিখেছিলেন, কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতাও একই বলা চলে।

++বৃক্ষ যদি বৃদ্ধ হয়++

“পাহাড়ের ক্ষয় আছে। নদী একদিন শীর্ণ হয়ে আসে। বৃক্ষ বৃদ্ধ হয়। এই অবস্থায় লেখক কত দিন লেখক থাকতে পারেন? তাঁরও তো ক্ষয় আছে। শারীরিক ক্ষয়ের প্রশ্ন তো আছেই। লেখক সত্তারও তো ক্ষয় আছে।

সে কথা কতটা মনে থাকে। লিখে লিখে পাঠক তৈরি হয়ে গেলে লেখক লেখক হয়ে যান। তার পর তৈরি পাঠককে লেখক লেখা দিতে থাকেন। একটা সময় আসে— যখন দেখা যায়— পাঠক আর সে লেখা চাইছেন না। পাঠক আর আগের মতো স্বাদ পাচ্ছেন না। উপরন্তু নতুন নতুন পাঠক এসে গেছেন। তাঁরা নতুন খাবার চান। এই পালটে যাওয়া অবস্থা অনেক লেখক মেনে নিতে পারেন না। কিম্বা নিজেও নিজেকে বদলাতে পারেন না। ভাবেন— পাঠক যেমন নিচ্ছিলেন—তেমনই নিতে থাকবেন। এই দুঃখজনক অবস্থা সৃষ্টি হয় প্রধানত লেখকের জন্যে। আর সৃষ্টি হয় সম্পাদকের কল্যাণে। কোনও এক সময় লেখকের লেখা ছেপে সম্পাদক সাড়া পেয়েছিলেন। কয়েক বার সাড়া পেয়ে মনে হয় নিরন্তর সাড়া পেয়ে যাব।

পত্রিকার রথ নিজের গতিতে সর্বদাই কিছুটা গড়গড় করে গড়ায়। সেই গড়গড়ানো লেখকের লেখার সাড়া ভ্রমে সম্পাদক নিরন্তর যদি পাঠকের ওপর লেখককে চাপিয়ে দেন—তখনই দুঃখের ঘটনা ঘটে।

পাহাড়, নদী, গাছের কর্মকাণ্ড বা ক্ষয় হঠাৎ বোঝা যায় না। এদের জয় বা ক্ষয়- দুটোই খুব বড়। কিন্তু ধীরে ধীরে। তাই দেখা যায় না। সে তুলনায় লেখক একজন মানুষ মাত্র। জেমা, অভিমান, অহম্ ইত্যাদির পুঁটুলি এই লোকটির ক্ষয় ও জয় বেশ চোখে পড়ার। তাই বোধ হয় তাঁর অবসর নেওয়ারও একটা সময় আছে।
কিন্তু ঘটনা দেখা যায় অন্য রকম।

আমরা লেখক। অন্য গ্রহ থেকে এসে এই ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছি। নিত্য প্রসবিনী। নিত্য প্রকাশমান। অশক্ত না হওয়া অবধি লিখে যাব।

নিষ্ঠুর সময় বালির ঝাপটায় অপ্রয়োজনীয় জিনিস চাপা দিয়ে ঢেকে ফেলছে। পাহাড়ের গা বর্ষার জলে ক্ষয় হয়ে ধসে পড়ছে। মোহনা থেকে পালটা ধাক্কায় পলি ফিরে এসে নদীর বুকে চর তুলে দিচ্ছে। চার হাজার বছরের প্রাচীন রেড উড গাছ সভ্যতার পর সভ্যতার জন্ম ও মৃত্যুর ফেনা গায়ে মেখে নিয়ে নিজের উচ্ছেদের দিনটি শুনতে থাকে। আর একজন লেখক — সামান্য মানুষ— তিনি কী করে প্রকৃতির নিয়ম অতিক্রম করবেন?

বাবুর প্রথম গল্প ১৯৪৬ সনে সাড়া জাগিয়েছিল। ১৯৫৬ সনে তিনি যুগের প্রথম মশালচি হয়ে দেখা দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৬৬ সাল থেকেই তিনি একটি নাম। এবং এই নাম হবার পর থেকেই তিনি অহম্, যা-লিখি-তাই-ই-লেখার মনোভাবে তিনি আচ্ছন্ন হয়ে যান। তখন আর তিনি শিল্প নন। তিনি পত্রিকার অলংকার।

সংঘর্ষ, আবিষ্কার, নিজের মুখোমুখি দাঁড়ানোর ব্যাপারটা লেখকের ভেতর থেকে যেদিন উবে যায়— প্রাকৃতিক কারণেই উবে যেতে বাধ্য— তখন লেখককে প্রধানত মাথার ভেতরে বীজ বুনতে হয় গল্পের। লিখতে লিখতে সেই গল্পগাছের বৃত্তে ফুল আসে। তা দেখতে হয়তো ভালো। কিন্তু তা ফুল নয়।

বিষ্ণুপুর থেকে বাঁকুড়া যাবার পথে জ’পুরের জঙ্গলে দেখেছি— পুরনো গাছের জায়গায় তরুণ শাল চারা বসানো হচ্ছে।
লামডিং থেকে বিশ মাইলের ভেতর চা বাগানে দেখেছি ৬০ বছর বয়সের চায়ের ঝাড়কে লোহার চেনে বেঁধে ট্রাক্টর শেকড়-শুদ্ধ টেনে তুলছে। জানলাম, চায়ের ঝাড়ের আয়ু মানুষের মতোই। পীচে বালক, বিশে জওয়ান, চল্লিশে প্রবীণ, ষাটে বিদায়ী।
তাই— ভাবছিলাম, বৃক্ষ যদি বৃদ্ধ হয়— তাহলে....”